ফিলিস্তিনের নিপিড়িত জনগনের অন্যতম কন্ঠস্বর ছিলেন সাংবাদিক আনাস আল শারিফ। ইসরায়েলি সন্ত্রাসী বাহিনির গুলি, বোমা বিস্ফোরন বা হত্যাযজ্ঞ বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতেন এই নির্ভিক সাংবাদিক। দীর্ঘদিন যাবত তাকে হত্যার চেষ্টা করতে থাকে ইসরায়েলী সন্ত্রাসী বাহিনি। পরবর্তীতে আসলো সেই কালো দিন। ১১ আগস্ট গাজায় হামলায় তাকে হত্যা করে ইসরায়েলি সন্ত্রাসী গোষ্ঠি। শাহাদাত চুড়ান্ত জেনে আগে থেকেই মৃত্যু পরবর্তী বার্তা দিয়ে যান এই নির্ভিক সাংবাদিক শারিফ।
সোমবার (১১ আগস্ট) তার ফেসবুকে তার শেষ বার্তা টি প্রকাশ করা হয়।
সেই বার্তাটিতে আনাসের কথা গুলা বাংলায় রুপান্তর করা হলো, এটাই আমার শেষ ইচ্ছা এবং চূড়ান্ত বার্তা। যদি এই কথাগুলো তোমাদের কাছে পৌঁছে, তবে জেনে রাখো ইসরায়েল আমাকে হত্যা করে আমার কণ্ঠকে স্তব্ধ করতে সফল হয়েছে।
প্রথমেই আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহু। আল্লাহ সাক্ষী—আমি আমার সর্বশক্তি ও সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে আমার জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছি, তাদের কণ্ঠ হয়েছি, সেই দিন থেকে যেদিন আমি চোখ খুলেছি জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরের গলিপথ আর রাস্তায়। আমার আশা ছিল, আল্লাহ আমাকে এতটুকু জীবন দিবেন যেন আমি আমার পরিবার ও প্রিয়জনদের নিয়ে ফিরে যেতে পারি আমাদের আসল শহর—অধিকৃত আসকালান (আল-মাজদাল)-এ। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছাই আগে, তাঁর ফয়সালা চূড়ান্ত।
আমি জীবনের প্রতিটি কষ্ট নিজের চোখে দেখেছি, বহুবার বেদনা আর ক্ষতির স্বাদ পেয়েছি। তবুও কখনো সত্যকে বিকৃত না করে, গোপন না করে, ঠিক যেমন আছে তেমন করেই পৌঁছে দিয়েছি—যাতে আল্লাহ সাক্ষী থাকেন তাদের বিরুদ্ধে যারা চুপ ছিল, যারা আমাদের হত্যাকে মেনে নিয়েছে, যারা আমাদের শ্বাসরোধ করেছে, আর যাদের হৃদয় আমাদের শিশু ও নারীদের ছিন্নভিন্ন দেহ দেখে পর্যন্ত নরম হয়নি, যারা কিছুই করেনি এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা এই গণহত্যা থামাতে।
আমি তোমাদের হাতে আমানত রেখে যাচ্ছি ফিলিস্তিনকে—মুসলিম বিশ্বের মুকুটের রত্ন, সারা বিশ্বের প্রতিটি স্বাধীন মানুষের হৃদস্পন্দন। আমি আমানত রেখে যাচ্ছি এর মানুষদের, সেই নিষ্পাপ শিশুদের, যারা স্বপ্ন দেখার বা নিরাপদে বাঁচার সময়ই পায়নি। হাজার হাজার টন ইসরায়েলি বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্রের নিচে যাদের পবিত্র দেহ চূর্ণ হয়ে গেছে, দেয়ালে ছিটকে ছড়িয়ে পড়েছে।
তোমরা যেন শৃঙ্খল বা সীমানায় আবদ্ধ হয়ে নীরব হয়ে যেও না। মুক্তির সেতু হয়ে দাঁড়াও—এই ভূমি ও এর মানুষদের জন্য, যতক্ষণ না মর্যাদা ও স্বাধীনতার সূর্য ওঠে আমাদের ছিনিয়ে নেওয়া মাতৃভূমির আকাশে। আমি আমার পরিবারকে তোমাদের হাতে আমানত রেখে যাচ্ছি।
আমি আমার প্রিয় কন্যা শাম—আমার চোখের মণি—তোমাদের হাতে আমানত রাখছি, যাকে আমি বড় হতে দেখতে পারলাম না যেমনটা স্বপ্ন দেখেছিলাম।
আমি আমার প্রিয় পুত্র সালাহ-কে আমানত রাখছি, যাকে আমি জীবনের পথে সঙ্গ দিতে চেয়েছিলাম, শক্ত করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম, যাতে সে আমার দায়িত্ব তুলে নিয়ে মিশন চালিয়ে যেতে পারে।
আমি আমার প্রিয় মা-কে আমানত রাখছি, যার দোয়া আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে, যার দোয়া ছিল আমার দুর্গ, আর যার আলো আমার পথ দেখিয়েছে। আল্লাহ তাঁকে শক্তি দিন, আর আমার পক্ষ থেকে সর্বোত্তম প্রতিদান দিন।
আমি আমার জীবনসঙ্গিনী—প্রিয় স্ত্রী উম্মে সালাহ (বায়ান)-কে আমানত রাখছি, যাকে যুদ্ধ অনেক দিন ও মাস ধরে আমার থেকে আলাদা করেছে। তবুও সে অটল থেকেছে, যেমন জলপাই গাছের কাণ্ড কখনো বাঁকে না—ধৈর্যশীল, আল্লাহর ওপর আস্থা রাখা, আর আমার অনুপস্থিতিতে সর্বশক্তি ও ঈমান দিয়ে দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে।
আমি তোমাদের অনুরোধ করছি—তাঁদের পাশে দাঁড়াবে, আল্লাহর পরে তাঁদের আশ্রয় হবে। যদি আমি মারা যাই, তবে আমি আমার নীতিতে অটল থেকে মরব। আমি আল্লাহর সামনে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমি তাঁর ফয়সালায় সন্তুষ্ট, তাঁর সাথে সাক্ষাতের ব্যাপারে নিশ্চিত, আর নিশ্চিত যে আল্লাহর কাছে যা আছে তা-ই শ্রেষ্ঠ ও চিরস্থায়ী।
হে আল্লাহ, আমাকে শহীদদের দলে কবুল করো, আমার অতীত ও ভবিষ্যতের সব গুনাহ মাফ করো, আর আমার রক্তকে আলো বানাও—যা আমার জনগণ ও পরিবারের জন্য স্বাধীনতার পথ আলোকিত করবে। যদি কোনো ক্ষেত্রে আমি ত্রুটি করে থাকি, ক্ষমা করো, আর আমাকে জন্য রহমতের দোয়া করবে—কারণ আমি আমার অঙ্গীকার রেখেছি, কখনো বদলাইনি বা বিশ্বাসঘাতকতা করিনি।
গাজা যেন ভুলে যেও না… আর আমাকে ভুলে যেও না—আমার ক্ষমা ও কবুলিয়াতের জন্য তোমাদের আন্তরিক দোয়ায়।
আনাস জামাল আল-শারিফ ০৬.০৪.২০২৫
