শনিবার, জুন ৭, ২০২৫
প্রচ্ছদ্ধসারাদেশ'মাইয়ারেও বাঁচাতে পারলাম না’ - লামিয়ার মা

‘মাইয়ারেও বাঁচাতে পারলাম না’ – লামিয়ার মা

spot_img
spot_img

জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ জসিম হাওলাদারের কলেজপড়ুয়া কন্যা লামিয়া আক্তার (১৭) বাবার মৃত্যুর শোক কাটিয়ে ওঠার আগেই আরেকটি মর্মান্তিক ঘটনার শিকার হন। গত ১৮ মার্চ ২০২৫ পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলায় বাবার কবর জিয়ারত করে বাড়ি ফেরার পথে তিনি সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন। এই ঘটনার পর থেকে মানসিকভাবে ভেঙে পড়া লামিয়া নিজেকে ঘরে গুটিয়ে রাখতেন। কিছু প্রতিবেশীর কটূক্তি তাকে আরও বিপর্যস্ত করে। মা রুনা বেগম মেয়ের দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষা শেষ হলে তাকে নিয়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন।

কিন্তু তার আগেই গত শনিবার (২৬ এপ্রিল ২০২৫) রাতে ঢাকার আদাবরের শেখেরটেকে ভাড়া বাসায় ফ্যানের সঙ্গে গলায় কাপড় পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন লামিয়া। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মেয়ের মৃত্যুতে শোকে বিহ্বল মা রুনা বেগম বলেন, “ধর্ষণের পর মেয়েকে একা ছাড়িনি। সবসময় সঙ্গে রেখেছি। জামাই গেছে, মেয়েকেও বাঁচাতে পারলাম না।”

লামিয়ার আত্মহত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে রাতেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জুলাই ফাউন্ডেশন, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও বিএনপির নেতারা হাসপাতালে তার মরদেহ দেখতে যান। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আব্দুস সালাম বলেন, “এই সরকার কী জবাব দেবে? শহীদ পরিবারের নিরাপত্তা দিতে না পারলে দ্রুত নির্বাচন দিয়ে দায়িত্ব নির্বাচিত সরকারের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত।” শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধর ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ বলেন, “জুলাই শহীদদের পরিবারের নিরাপত্তা দেওয়া সরকারের প্রথম দায়িত্ব ছিল, কিন্তু রাষ্ট্র তাতে ব্যর্থ হয়েছে।”

জুলাই ফাউন্ডেশনের নির্বাহী সদস্য সাবরিনা আফরোজ সেবন্তি জানান, ধর্ষণের পর থেকে তিনি লামিয়ার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছিলেন। লামিয়া মানসিকভাবে ভীষণ ভেঙে পড়েছিল এবং জীবন নিয়ে হতাশায় ছিল। শনিবার সন্ধ্যায় সাবরিনা শেখেরটেকে লামিয়ার বাসায় গিয়েছিলেন। তখন লামিয়া চুপচাপ ছিল। প্রায় দুই ঘণ্টা কথাবার্তার পর বের হওয়ার সময় লামিয়া তাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, “ওপরওয়ালা যা করে ভালোর জন্য করে। আমার কী ভালো হয়েছে? আমার সঙ্গে শুধু খারাপই হয়েছে।” সাবরিনা তাকে পড়াশোনায় মনোযোগী হতে উৎসাহ দিয়েছিলেন। কিন্তু বাসা থেকে বের হওয়ার আড়াই ঘণ্টা পর লামিয়ার আত্মহত্যার খবর পান তিনি। সাবরিনা জানান, দুই সপ্তাহ আগে লামিয়া ঢাকায় আসে এবং জুলাই ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে তাকে কাউন্সেলিং দেওয়া হচ্ছিল।

রোববার (২৭ এপ্রিল ২০২৫) সকালে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গে লামিয়ার ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। মর্গে জুলাই-আগস্ট শহীদ পরিবারের সদস্যরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাদের অভিযোগ, সম্প্রতি শহীদদের কবরে হামলার ঘটনা ঘটেছে এবং অনেক পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। জুলাই ২৪ শহীদ পরিবার সোসাইটির চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, “অপমান সহ্য করতে না পেরে লামিয়া আত্মহত্যা করেছে। জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই।” আদাবর থানার ওসি এস এম জাকারিয়া জানান, ঘটনায় অপমৃত্যু মামলা হয়েছে এবং তদন্ত চলছে।

ময়নাতদন্তের পর স্বজনরা লামিয়ার মরদেহ পটুয়াখালীর দুমকির পাঙ্গাসিয়া গ্রামে নিয়ে যান। সন্ধ্যায় পাঙ্গাসিয়া বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে জানাজা শেষে বাবা জসিম হাওলাদারের কবরের পাশে লামিয়াকে সমাহিত করা হয়।

লামিয়ার দাদা আব্দুস সোবাহান হাওলাদার বলেন, “আমার নাতনি তো শেষ হয়ে গেছে। যদি কেউ তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে থাকে, তাদের ফাঁসি চাই।” স্থানীয় ইউপি সদস্য রানা হাওলাদার বলেন, “ধর্ষকদের কঠোর শাস্তি চাই, যাতে এমন জঘন্য ঘটনা আর না ঘটে।”

ধর্ষণের ঘটনায় লামিয়া বাদী হয়ে দুমকি থানায় শাকিব মুন্সি ও সিফাত মুন্সির বিরুদ্ধে মামলা করেন। শাকিব পাঙ্গাসিয়া এবিএম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র এবং সিফাত দুমকি সরকারি জনতা কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। সিফাত লামিয়ার সহপাঠী ছিল। পুলিশ দুজনকেই গ্রেপ্তার করেছে এবং তারা বর্তমানে কারাগারে রয়েছে।

পটুয়াখালীর পুলিশ সুপার আনোয়ার জাহিদ জানান, গত শনিবার দুই আসামির ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তিনি আরও জানান, ঘটনার সঙ্গে আরেকজনের সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া গেছে এবং তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

লামিয়ার বাবা জসিম হাওলাদার গত ১৯ জুলাই ২০২৪ ঢাকার মোহাম্মদপুরে ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের সময় গুলিবিদ্ধ হন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৯ জুলাই তিনি মারা যান। জসিম ঢাকায় একটি এনজিওতে গাড়িচালক হিসেবে কাজ করতেন এবং শেখেরটেকে স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলের সঙ্গে বসবাস করতেন।

আরো পড়ুন
- বিজ্ঞাপন -

সর্বাধিক পাঠিত