“বিশ্বের সেরা ও ভারতের প্রথম সিরিয়াল কি’লার ‘ঠগ বেহরাম’ (The King of Thugs)। সিরিয়াল কি’লার”- শব্দদুটো শুনলেই আমাদের মাথায় প্রথম যে নামগুলো আসে তাদের মধ্যে জ্যাক দ্য রি’পার, টেড বান্ডি অন্যতম। কিন্তু আজ আমি আপনাদের বিদেশিদের গল্প শোনাতে আসিনি। আজ আমি বলব এক অদ্ভুত গল্প। ফরেইন সিরিয়াল কি’লিং নিয়ে হয়ত আপনারা অনেক গল্প পড়েছেন, স্টাডি করেছেন, ফিল্ম দেখেছেন, দারুন ইন্টারেস্টিং লাগে আপনাদের, কিন্তু আপনারা কি জানেন, আমাদের এই প্রাচীন ভারতবর্ষ ছিল বিশ্বের সবচেয়ে ডে’ঞ্জারাস ও চালাক সিরিয়াল কি’লারের জন্মভূমি। জানতেন না তো!! চলুন আজ তাহলে সেই গল্পই হোক।
ঠগ বেহরাম- ভারতের প্রথম সিরিয়াল কি’লার বলা হয় যাকে, যিনি ১৭৬৫ সাল থেকে ১৮৪০ এই পঞ্চাশ বছরে আনুমানিক প্রায় ৯৩১ খানা খু’ন করেছিলেন ঠান্ডা মাথায় ও পরিকল্পিত ভাবে। বেহরামকে হত “কিং অফ দ্য ঠগস”, যিনি ছিলেন সতেরশো দশকের সবচেয়ে বড় আ’তঙ্ক ঠগী উপজাতিদের লিডার। এই ঠগী সম্প্রদায় আউধের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দেখা যেত। এরা এমনভাবেই প্ল্যানমাফিক খু’ন করত যে ভিক্টি’মদের ব’ডিও খুঁজে পাওয়া যেত না আর। এরা মেইনলি ছিল লু’টেরা বা ডা’কাত সম্প্রদায়। তবে এই ঠগীদের লিডার বেহরাম বিখ্যাত ছিল তার নৃ’শং’সতা ও ক্ষু’রধার বুদ্ধির জন্যে। এই জন্যেই এই বেহরাম ঠগীকে বিশ্বের অন্যতম ডে’ঞ্জারাস সিরিয়াল কি’লার বলা হয়।
উত্থান- ছোটবেলায় বেহরাম ছিলেন খুবই শান্তশিষ্ট, লাজুক ও ইন্ট্রোভার্ট। চট করে কারুর সাথেই মিশতেন না তিনি। সেই সময় ভারতবর্ষে ঠগীদের উত্থান অলরেডি হয়ে গেছে। ঠগী সম্প্রদায় মানে প্রফেশনাল ডা’কাতি ও খু’নেদের একটা অরগানাইজড দল হিসেবে ধরা হত। ইংলিশ শব্দ “Thug” টাও হিন্দি শব্দ “ঠগ” থেকে ধার নেওয়া, ঠগ মানে “লু’টেরা” বোঝানো হত সেই সময়ে। এই ঠগীরা সাধারনত রাস্তায় আগত ব্যবসায়ীদের লু’ঠ করত ও খু’ন করত, তাদের এই ডাকাতি এতটাই প্রিপ্ল্যানড থাকত যে ব্যবসায়ীরা ঠাওরও করতে পারত না তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে, যাই হোক সে ব্যাপারে পরে আসছি, লাজুক ছেলে বেহরাম কিভাবে এত কু’খ্যাত ও ভয়ং’কর ঠগী লিডার হয়ে উঠল সেই গল্পটা আগে জেনে নি:-
ঠগীদের অরিজিন সম্পর্কে অনেক মতবাদ শোনা যায়, যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল ম্যাকলয়েডের মতবাদ। তার মতে, ভারতের রাজধানী দিল্লী থেকে কিছু মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরা পালায় একজন রাজপরিবারের ডাক্তারকে খু’ন করে, পরবর্তী কালে তারাই এই ঠগী সম্প্রদায় বানায়।
আরেকজনের মতবাদ অনুযায়ী, আকবরের এক প্রিয় ও স্পেশাল দাসনেতাকে খু’ন করে কিছু মুসলিম ফ্যামিলি পালিয়ে আসে আউধে, তারাই এই ঠগী সম্প্রদায় ক্রিয়েট করে।
এই ঠগীরা জাত ধর্ম মানত না, পরে তারা এই ঠগী কালচার ছড়িয়ে দেয় ভারতের অন্যান্য জাতি যেমন রাজপুত, লোধি, আহির এদের মধ্যে। তৈরী হয় এক বিশাল বড় ও বিস্তীর্ন ঠগী সম্প্রদায়। কথিত আছে, এই ঠগী সম্প্রদায় এর সবাই ছিল ব’ঞ্চিত অত্যা’চারিতদের দল, যাদের মধ্যে অনেকে মোগল সেনা ছিল, অনেকে ব্রিটিশ সরকারের অধীনে কাজ করত। ধনী মালিক জাতির শো’ষনে এরা পী’ড়িত ছিল, তাই এই মালিকদের প্রতি এদের ঘে’ন্না, রা’গ তাদের এই কাজে নিয়ে আসে। আরো জানা যায়, যে ধর্মেরই হোক না কেন প্রতিটা ঠগী ছিল মা কালীর উপাসক। এবং এই ঠগীরা বিশ্বাস করত তারা যে খু’নগুলো করছে এগুলো আসলে পা’প নয়, সমাজ থেকে ধনীদের সরানোর মত একটা পুন্য করছে তারা।
এবার আসি বেহরাম প্রসঙ্গে। ছোট্ট বেহরাম এতই লাজুক ছিল যে তার কোন বন্ধু ছিল না। তখনই এই নিঃ’সঙ্গ বেহরামের সাথে বন্ধুত্ব হয় সইদ আলি আলির, যে ছিল ঠগী সম্প্রদায়ের এক কু’খ্যাত লিডার এবং বেহরামের থেকে ২৫ বছরের বড়। সইদ আমির আলির বন্ধুত্ব কিশোর বেহরামের মনে এতই প্রভাব বিস্তার করে যে সেও একজন ঠগী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই সইদ আমির আলি বেহরামকে প্রথম পরিচয় করায় ঠগী সম্প্রদায়ের সাথে, বেহরামের কাছে এক নতুন জগতের রাস্তা খুলে যায় তখন। শুনলে খুব অবাক লাগবে, মাত্র দশ বছর বয়স থেকেই বেহরাম খু’ন করা শুরু করে, এবং নিজের নৃ’শংসতা দিয়ে মানুষের মধ্যে ভয়া’নক আত’ঙ্কের সৃষ্টি করে। অবশেষে ২৫ বছর বয়সে তাকে ঠগীদের লিডার বানানো হয়, ততদিনে বেহরাম মনে প্রানে একজন প্রফেশনাল ঠগী হয়ে গেছে। এরপর বেহরামের সাথে একজন মহিলা ঠগী যার নাম ছিল ডলি, তার সাথে প্রেমও হয়। কিন্তু তারা আবার আলাদাও হয়ে যায়। বেহরাম নিজেকে তখন পুরোপুরি সঁপে দেয় ঠগী সম্প্রদায়ের কাছে।
•• বেহরামের সিরিয়াল কি’লিং- এখন হয়ত ভাবছেন যে, বেহরাম বাকি খু’নে ডাকা’তদের মতই তো একজন ছিল, তাহলে তাকে দুনিয়া সিরিয়াল কি’লার কেন নাম দিয়েছে!!! সিরিয়াল কিলিং এর জগতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল কি’লিং এর প্যাটার্ন, কিলার নিজস্ব এক ট্রেন্ড বা প্যাটার্ন অনুযায়ী খু’ন করে। বেহরামও নিজের একটা ইউনিক প্যাটার্ন বানিয়েছিল খু’নের জন্যে। পরে সেটা আস্তে আস্তে সব ঠগীরাই অনুসরণ করে।
সময়টা তখন ১৭৯০, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর রাজত্বকাল চলছে তখন। ওই সময়ের আগে ঠগীরা রাস্তায় যাওয়া সকল ব্যবসায়ীদের লুঠ করত, ও তাদের বুকে পোষাকের ভিতর লুকানো “কা’টার” নামক ভো’জালি বা “ডা’টুরা” নামক মারণ বি’ষ দিয়ে হ’ত্যা করে কুয়োতে ফেলে দিত ব’ডি। কিন্তু এই পদ্ধতি বেশিদিন চলেনি, বেহরাম ঠগী লিডার হওয়ার পর কিছু ইউনিক পদ্ধতি ইউজ করা শুরু করে যাতে তাদের উদ্দেশ্য ব্যাবসায়ীরা কিছুতেই না বুঝতে পারে ও যাতে তাদের কোনভাবেই ট্রেস না করা যায়। চলুন বেহরামের এই ইউনিক পদ্ধতিগুলো যার জন্যে তাকে মোস্ট ডেঞ্জারাস সিরিয়াল কি’লার বলা হত সেগুলো এবার জেনে নি:-
১) বেহরাম হলুদ রঙের একটা কাপড় ব্যবহার করা শুরু করে, এই কাপড়টাকে সে রুমালের মত করে মডিফাই করে নিয়েছিল, এবং রুমালের মাঝে ছিল একটা শক্ত গিট্টু। এই রুমাল সে ভি’ক্টিমের গ’লায় এমনভাবে চে’পে মো’চড় দিত যে বিনা কোন শব্দ বিনা কোন হাতাহাতি করে ভি’ক্টিম মা’রা পড়ত।
২) রাস্তার মুখে বেহরামের দলের বেশ কিছু ঠগীরা লুকিয়ে থাকত। ব্যবসায়ীদের দল দেখতে পেলেই তারা শিয়ালের কান্নার মত অদ্ভুত একটা আওয়াজ করে তাদের বাকি মেম্বারদের সতর্ক করত। সেই আওয়াজ শোনা মাত্রই, বেহরাম তাদের ঠগী দলকে সাথে নিয়ে নেমে পড়ত রাস্তায় লু’ঠ করার জন্যে।
৩) এই পদ্ধতিটা ছিল সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং। বেহরামের আত’ংক এত ছড়িয়েছিল যে তাদের আশেপাশের রাস্তাগুলো ব্যবসায়ীরা ব্যবহার করা অনেক কমিয়ে দিয়েছিল। যার ফলে লুঠ অনেক কমে যাচ্ছিল বেহরামের। তখন সে তার লুঠের পদ্ধতি একটু চেঞ্জ করে। পুরো ঠগীরা অন্য রাস্তায় একজন ব্যবসায়ী সেজে বেরোত, তাদের গায়ে থাকত ব্যবসায়ীদের পোষাক ও সাথে থাকত বেশ কিছু ব্যাগেজ। তারা ব্যবসায়ীদের মতই হুবহু চলাফেরা করত, কথাবার্তা বলত। স্বাভাবিক ভাবেই অন্য ব্যবসায়ীদের তাদের দেখে কোন স’ন্দেহই হত না। ব্যবসায়ীদের আরো বিশ্বাস অর্জন করার জন্যে বেহরাম ও তার দল কখনো কখনো অনেক দিন তাদের সাথে গল্পগুজব করে, বা আনন্দ আমোদ করে কাটাতো, যাতে তাদের মনে হয় এরাও তাদের মতই নিরীহ ব্যবসায়ী। বেহরাম নিজের দলের ঠগীদের সাথে “রামোসি” নামের এক মিষ্টি ভাষায় কথা বলত বেশিরভাগ, যাতে তাদের প্ল্যান ভিক্টিমরা বুঝতে না পারে। এরকম ভাবে কিছুদিন চলার পর হঠাত কোনদিন বিশেষত সন্ধ্যের দিকে, একদল ঠগী ব্যবসায়ীদের কথায়,গল্পে ব্যস্ত রাখত, সেইসময় পিছন দিয়ে অন্য ঠগীরা সেই হলুদ রুমালের ফাঁ’স দিয়ে অত’র্কিত হাম’লা করত ব্যবসায়ীদের উপর, ব্যবসায়ীরা কিছু বোঝার আগেই তাদের খেল খ’তম হয়ে যেত। বেহরাম তখন তাদের সমস্ত টাকা পয়সা, জিনিস পত্র সব লুঠ করে নিয়ে বডিগুলো পু’তে দিত কোন নির্জন অঞ্চলে, যাতে কোনভাবেই ঠগীদের উপস্থিতির ট্রেস না পাওয়া যায়। কখনো কখনো তারা ব’ডিগুলোকে অনেক দূর অব্দি কাধে করে বয়ে নিয়ে যেত, তারপর হা’পিশ করে দিত বডিগুলো। এটাই ছিল বেহরামের সবচেয়ে ইউনিক পদ্ধতি। যেটা বেহরামের পরেও ঠগীরা অনুসরণ করতে থাকে। বেহরাম এতই চালাক ছিল যে সে ব্যবসায়ীদের দলের জাত আগে চিনে নিয়ে সেই জাত অনুযায়ী ছদ্মবেশ নিত। মানে হিন্দু ব্যবসায়ী হলে তারাও হিন্দু ছদ্মবেশ ধরত আর মুসলিম ব্যবসায়ী হলে তারাও মুসলিম ছদ্মবেশ ধরত।
ইতিহাসবিদদের মতে, বেহরামের চালাকি অন্য লেভেলের ছিল। তারা ব্যবসায়ীদের নানা অছিলায় অন্যমনস্ক করে রাখত বা তাদের মনোযোগ অন্য দিকে করে রাখত, যাতে অত’র্কিত হাম’লার ব্যাপারে তারা কিছুই বুঝতে না পারে। এছাড়াও বেহরামের আরেকটা দারুন পদ্ধতি ছিল তারা কোনদিন সেইসব ব্যবসায়ী দলকে টার্গেট করত না যাদের লোকসংখ্যা তাদের চেয়ে বেশি থাকত।
প’তন- বেহরামের ঠগী দল ৫০ বছর ধরে এরকম লুঠতরাজ চালানোর পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর এক অফিসার জেমস প্যাটন এর কাছে প্রচুর ধনী ব্যবসায়ীদের দলের ও অন্য কনভয়ের নি’খোঁজ সংবাদ জমতে থাকে, তিনি বেহরাম ও তার দলের ব্যাপারে সরেজমিনে তদ’ন্ত শুরু করেন। এরপর কয়েক মাস পরে বেহরাম ধরা পড়ে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী তাকে ফাঁ’সীতে ঝোলায়, তখন বেহরামের বয়স ৭৫ বছর। এভাবেই বেহরামের আতং’ক শেষ হয়। কিন্তু ঠগীদের দমন করা পুরোপুরি ভাবে সম্ভব হয়নি তখন। অবশেষে ১৮৩০ সালে গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিংক ও তার চিফ ক্যাপ্টেন উইলিয়াম হেনরি স্লিম্যান সারা দেশের সমস্ত ঠগ সম্প্রদায়কে চিহ্নিত করে আক্র’মন শুরু করে, বহু ঠগী গ্রেফ’তার হয় ও তাদের মে’রে দেওয়া হয়। এভাবে আস্তে আস্তে ভারতে ঠগীদের আতং’ক কমতে থাকে, ও ১৮৭০ সালে সারা ভারত থেকে গোটা ঠগী সম্প্রদায়কে নিকেশ করা হয়।
ঠগীরা ভাল ছিল কি মন্দ জানা নেই, তবে অনেক নিরীহ ব্যবসায়ীদেরও তারা খু’ন করত, তাই ইতিহাস তাদের অপ’রাধী ও ডা’কাত হিসেবেই চেনে। কিন্তু বেহরামের মত চালাক ও ধূ’র্ত লিডার ঠগী সম্প্রদায়ে আর হয়নি। তার সিরিয়াল কি’লিং পদ্ধতি গোটা বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল।
তাই আজো সারা বিশ্বে “বেহরাম ঠগ” টপ মোস্ট সিরিয়াল কিলা’রদের মধ্যে অন্যতম হয়ে আছে।
শেষ করার আগে ছোট্ট একটা র’হস্য বলে শেষ করি। এই বেহরাম ৯৩১ জনকে লুঠ করে এক বিশাল পরিমান খাজানা বানিয়েছিল, যার মধ্যে ছিল সোনা,রুপো,দামী পাথর ইত্যাদি। এই খাজানা বেহরাম কোথায় রেখেছে বা কোথায় পুতে রেখেছে আজো কেউ জানতে পারেনি। সমগ্র ইতিহাসে বেহরামের এই অসীম খাজানার সন্ধান আজো এক অজানা রহ’স্য হয়ে রয়ে গেছে।