আরফাত আহমেদ রনি, “ইনকিলাব জিন্দাবাদ” – এই স্লোগানটি শুধু একটি শব্দ নয়, বরং এটি বিপ্লব, প্রতিরোধ ও নতুন সম্ভাবনার প্রতীক। ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে উৎসারিত এই স্লোগান বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) হাত ধরে নতুন প্রাণ পেয়েছে। এই প্রতিবেদনে স্লোগানটির ঐতিহাসিক পটভূমি এবং বাংলাদেশের সমকালীন প্রেক্ষাপটে এর তাৎপর্য তুলে ধরা হলো।
“ইনকিলাব জিন্দাবাদ” একটি হিন্দুস্তানি বাক্যাংশ, যার অর্থ “বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক”। ইনকিলাব শব্দটি আরবি “ইকলাব” থেকে এসেছে, যার অর্থ পরিবর্তন বা বিপ্লব, আর জিন্দাবাদ ফারসি শব্দ, যার অর্থ দীর্ঘজীবী হওয়া। ১৯২১ সালে উর্দু কবি ও ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা হাসরাত মোহানি আমেদাবাদের কংগ্রেস অধিবেশনে এই স্লোগান প্রথম উচ্চারণ করেন। রুশ বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত তিনি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে এটি প্রচার করেন।
১৯২০-এর দশকের শেষে বিপ্লবী ভগত সিং এই স্লোগানকে জনপ্রিয় করে তোলেন। ১৯২৯ সালে তিনি ও বটুকেশ্বর দত্ত দিল্লির কেন্দ্রীয় আইনসভায় বোমা নিক্ষেপের পর এই স্লোগান উচ্চারণ করেন, যা ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রতীকী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। ভগত সিংয়ের দৃষ্টিতে ইনকিলাব শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমূল পরিবর্তনের আহ্বান ছিল। এটি হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের অফিসিয়াল স্লোগানও হয়ে ওঠে।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পর এই স্লোগান ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে বিভিন্ন আন্দোলনে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে এটি ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নতুন করে প্রাণ পায়।
২০২৪ সালের জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র রূপ নেয়। এই সময় তরুণরা “ইনকিলাব জিন্দাবাদ” স্লোগানটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে, যা শেখ হাসিনার ১৬ বছরের শাসনের পতনের প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হয়। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২০২৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আত্মপ্রকাশ করে। দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ নেতারা তাদের বক্তৃতায় এই স্লোগানটি বারবার ব্যবহার করেন, যা দলের আদর্শের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে যায়।
এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব গণমাধ্যমকে বলেন, “ইনকিলাব জিন্দাবাদ আমাদের দলীয় স্লোগান নয়, তবে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে এটি জনগণের প্রতিরোধের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছে। আমরা এর চেতনাকে ধরে রাখতে চাই।” তিনি জানান, দলটির স্লোগান, গঠনতন্ত্র ও পতাকা এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
জাতীয় নাগরিক পার্টি বাংলাদেশের রাজনীতিতে তরুণ নেতৃত্বের প্রতিনিধিত্ব করছে, যার লক্ষ্য গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, নতুন সংবিধান প্রণয়ন এবং সামাজিক ন্যায়বিচার। “ইনকিলাব জিন্দাবাদ” স্লোগানটি এই দলের আদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, কারণ এটি আমূল পরিবর্তনের প্রতীক। দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম “সেকেন্ড রিপাবলিক” বা দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেন, যা পুরোনো শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন করে নতুন গণতান্ত্রিক কাঠামো গড়ার স্বপ্ন বহন করে। এই স্লোগান তরুণদের মধ্যে আশা ও উদ্দীপনা জাগিয়ে তুলছে।
এনসিপির জন্য এই স্লোগানের তাৎপর্য তার সর্বজনীন আবেদনে। এটি রাজনৈতিক পরিবর্তনের পাশাপাশি শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতি বহন করে। এটি জুলাই আন্দোলনের স্মৃতি ধরে রেখে নতুন প্রজন্মকে ঐক্যবদ্ধ করছে, যা দলের ভবিষ্যৎ পথচলায় শক্তি যোগাবে।
“ইনকিলাব জিন্দাবাদ” স্লোগানটি এনসিপির জন্য একটি শক্তিশালী প্রতীক হিসেবে কাজ করছে। এটি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনাকে বাঁচিয়ে রাখছে এবং তরুণদের মধ্যে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করছে। এই স্লোগানের মাধ্যমে দলটি জনগণের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতে চায়, যা সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের পথে তাদের পথপ্রদর্শক হবে।
দলটির নেতারা এই স্লোগানকে একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসেবে দেখছেন, যা তাদের গণতান্ত্রিক আদর্শকে আরও শক্তিশালী করবে। তরুণ প্রজন্মের উৎসাহ এবং জনগণের সমর্থনের মাধ্যমে এনসিপি এই স্লোগানের চেতনাকে বাস্তবে রূপ দিতে পারে। এটি কেবল রাজনৈতিক পরিবর্তন নয়, বরং একটি ন্যায়ভিত্তিক, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নের প্রতিনিধিত্ব করে।

স্টাফ রিপোর্টার,
বাংলা আপডেট