◑ ছায়া যুদ্ধ থেকে সরাসরি সংঘাত –
মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতি ও ভূ-রাজনৈতিক দৃশ্যপট দশকের পর দশক ধরে চলমান এক ছায়া যুদ্ধের জটিল সমীকরণ। এখানকার আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, অর্থনৈতিক প্রভুত্ব, জাতিগত বিভেদ এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এই অঞ্চলকে সমান্তর ধারায় অস্থিতিশীল করে তুলছে ক্রমে।
এইসবের মাঝে সম্প্রতি ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে যে প্রত্যক্ষ সংঘাতের জন্ম হয়েছে, তা কেবল মধ্যপ্রাচ্য নয়, গোটা বিশ্বের জন্য এক গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে! ২০২৫ সালের শুরু থেকে মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে যে উত্তেজনার কালোমেঘ জমা হচ্ছিলো তার সর্বশেষ ও ভয়াবহ রূপ হচ্ছে এই ইরান-ইসরায়েল সামরিক সংঘাত। বহুদিন ধরে চলা ছায়াযুদ্ধ, অর্থাৎ সাইবার হামলা, গোপন গুপ্তহত্যা ও পরোক্ষ সংঘর্ষ—সবকিছুর সীমা পেরিয়ে এখন সরাসরি এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করছে। এই পরিস্থিতি শুধু দু’টি রাষ্ট্রের নয়, বরং গোটা মধ্যপ্রাচ্য, এমনকি বিশ্ব রাজনীতির দিকনির্দেশনাকেও প্রভাবিত করছে।
◑ ঘটনাক্রম ও উত্তেজনার উৎস
এই বছরের এপ্রিলে সিরিয়ায় ইরানি কনস্যুলেটে ইসরায়েলের বিমান হামলায় আইআরজিসি’র (Islamic Revolutionary Guard Corps) একাধিক সিনিয়র কর্মকর্তা নিহত হন। ইরান তাৎক্ষণিকভাবে এটিকে “রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস” আখ্যা দিয়ে পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় সরাসরি ইসরায়েল ভূখণ্ডে ৩০০টিরও বেশি ড্রোন ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় (সূত্র: Al Jazeera, April 2025)। যদিও ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্র দেশগুলোর সমন্বয়ে অধিকাংশ ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করা হয়, তবে স্পষ্টতই যুদ্ধের প্রকৃতি পাল্টে যায়।
এদিকে গত ১৩ জুন’২৫ ভোররাতে ইসরায়েল ইরানের উপর ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ নামে আবারও এক বড় আকারের হামলা চালায়; প্রাথমিক হামলার ঢেউ ইরানের বিভিন্ন সামরিক ও পারমাণবিক কেন্দ্র ও রাডার বেসড স্থাপনা লক্ষ্য করে চালানো হয়। এর কয়েক ঘণ্টা পর একইদিনে দুপুরের দিকে ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ইসফাহান, তাবরিজ ও তেহরান মেহরাবাদ বিমানবন্দরে একটি দ্বিতীয় ও পৃথক হামলার খবর আমরা শোনতে পাই আন্তর্জাতিক মিডিয়ার বরাতে! এই বহুমুখী হামলা ইরানের সামরিক সক্ষমতা ও পারমাণবিক কর্মসূচির ওপর ইসরায়েলের সরাসরি আক্রমণের ইঙ্গিত দেয়। যদিও ইরান দাবী করে, পরমাণু কর্মসূচিতে বড় কোনো ক্ষতি হয়নি; তবে এতে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কর্মকর্তা ও বৈজ্ঞানিকসহ এখন পর্যন্ত ইরানের অন্তত ৭৮ জন নিহত ও ৩৩০ জনের মতো আহত হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। ইরানও থেমে থাকার নয়, ইতোমধ্যে সুস্পষ্ট বার্তা দিয়ে দিয়েছে – “যুদ্ধ এখন আমাদের দোরগোড়ায়।’
◑ আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া
এই হামলা এবং তার প্রতিক্রিয়ার ফলে এখন শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয় আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিতে ইতোমধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে!
– যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য প্রকাশ্যে ইসরায়েলের পাশে দাঁড়ালেও যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে ব্যাক চ্যানেলে তৎপর।
– চীন ও রাশিয়া পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকার সমালোচনা করে ইসরায়েলকে ‘অতিমাত্রায় উৎসাহী’ বলেছে।
– সৌদি আরব, কাতার ও তুরস্ক সংযত ভূমিকা নিয়ে উভয়পক্ষকে সংলাপে ফেরার আহ্বান জানিয়েছে।
– জাতিসংঘ মহাসচিব যুদ্ধ বন্ধে জরুরি বৈঠকের আহ্বান করলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ এখনও দৃশ্যমান নয়।
◑ ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি ও অর্থনৈতিক অভিঘাত – মধ্যপ্রাচ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধের শঙ্কা: লেবাননেরহিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুতি, ইরাকের কাতাইব হিজবুল্লাহ সহ একাধিক প্রো-ইরানিয়ান গ্রুপ সক্রিয়ভাবে সংঘাতে যুক্ত হতে পারে। এতে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও জর্ডানের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে।
– জ্বালানি সরবরাহের অনিশ্চয়তা: হরমুজ প্রণালী দিয়ে বিশ্ব তেলের প্রায় ২০ শতাংশ সরবরাহ হয়। সেখানে উত্তেজনা বাড়লে তেলের দাম ব্যারেল প্রতি $150 ছাড়াতে পারে (বিশ্লেষণ: Goldman Sachs)। ইতোমধ্যেই তেলের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে।
– পরমাণু নিরাপত্তার হুমকি: ইসরায়েল ইঙ্গিত দিয়েছে, ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরির পথে অগ্রসর হলে তারা আগাম প্রতিরোধমূলক হামলার পথে যাবে। এটি একটি বিপজ্জনক ধাপ, যা কেবলমাত্র আঞ্চলিক নয়, বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্যও হুমকিস্বরূপ।
◑ একটি মানবিক সংকট: উপেক্ষিত দিক –
এই পুরো পরিস্থিতির সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক দিক হচ্ছে সাধারণ মানুষের দুর্দশা। গাজা, পশ্চিম তীর, সিরিয়া ও ইরানে ইতোমধ্যেই সহস্র নিরীহ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। বহু পরিবার আজ ঘরছাড়া ! হাসপাতালগুলোতে সংকট তৈরি হয়েছে। গাজার স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের হিসেব অনুযায়ী সর্বশেষ ১৪ জুন’২৫ পর্যন্ত চলমান এই ইসরায়েলী বর্বরতম গণহত্যায় নিহতের সং্খ্যা ৫৭,০০০ এরও বেশি, আহত লক্ষাধিক; পঙ্গুত বরণ করেছে অসংখ্য – তার মধ্যে অধিকাংশই নারী ও শিশু! এটি কেবল পরিসং্খ্যন নয়, একটি জাতি – একটি সংস্কৃতি – একটি রাষ্ট্র নিশ্চিহ্নের চাক্ষুষ প্রতীক!
খাদ্য, পানি, বিদ্যুৎ, ওষুধ– সবকিছুর অবরোধ;
সংবাদপত্র, সাংবাদিক, আন্তর্জাতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে সত্য লুকানোর অপচেষ্টা;
জাতিসংঘ পরিচালিত স্কুলে শরণার্থীদের ওপর হামলা, মানবিক সহায়তা নিতে আসা ক্ষুধার্ত মানুষের ওপর গুলি – এই ঘটনাগুলি আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সরাসরি যুদ্ধাপরাধ ও মানবাধিকের চরমসীমা অতিক্রমের সামিল। এরপরও আমরা অদ্ভুভাবে লক্ষ্য করছি বিশ্ববিবেকের অদ্ভুত নীরবতা! আজও মুসলিম ও আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যেও ঐক্যের অভাব, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বারবার তদন্ত দাবি করলেও বিচার বা শাস্তি নেই, জাতিসংঘের কোন লক্ষ্যণীয় পদক্ষেপ নেই! সবার নীরবতা এটিই প্রমাণ করে – এটি একটি state-sponsored, technologically organized genocide যেখানে লক্ষ্য কেবল হামাস নয়—একটি জাতি, একটি জনগোষ্ঠী, একটি ভূখণ্ডকে চিরতরে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার প্রচেষ্টা!
◑ মানবিক জাগরণ জরুরি
যুদ্ধটা শুধু আজ ফিলিস্তিনি, সিরিয়ান বা ইরানিদের নয়; মানবতাবাদ, সভ্যতা, বিবেক এবং আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের এক পরীক্ষাস্থল। আমরা নীরব থাকলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না
◑ সম্ভাবনার জানালা
সব অন্ধকারের মধ্যেও কিছু আশাবাদের আলো খোঁজা যেতে পারে—
– সৌদি-ইরান সমঝোতা নতুন কৌশলগত ঐক্যের সম্ভাবনা তৈরি করছে। চীন এই সমঝোতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
– দুই রাষ্ট্র সমাধান নিয়ে ইউরোপের জনমত আরও স্পষ্ট হচ্ছে। ফ্রান্স ও স্পেন ইতিমধ্যে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
– চীন, তুরস্ক ও কাতারের মধ্যস্থতা উদ্যোগ আগামীর জন্য একটি শান্তিপূর্ণ সমঝোতা প্রক্রিয়া হতে পারে।
◑ বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার করণীয় –
বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য এই যুদ্ধের প্রভাব সরাসরি না হলেও, পরোক্ষভাবে বেশ গভীর। এক্ষেত্রে গত এপ্রিলে আমার আহবানে ডাকা ‘বাংলাদেশ – ফিলিস্তিন সংহতি মঞ্চ’- এর বিক্ষোভ সমাবেশে উত্থাপিত ৭ দফা দাবীসমূহ প্রণিধানযোগ্য মনে করছি।
◑ দাবীসমূহ ছিলো –
১. বাংলাদেশ-ইসরাইল কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক সম্পর্ক ও ভবিষ্যত সম্ভাবনা স্থায়ীভাবে বাতিল ঘোষণা করতে হবে।
২. পতিত স্বৈরাচারের আমলে সামরিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার অতীত চুক্তিসমূহ জনসমক্ষে প্রকাশ করে তা বাতিল করতে হবে।
৩. ফিলিস্তিনে ইসরাইলের গণহত্যার প্রতিবাদে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কর্মসূচি পালন করতে হবে।
৪. জাতিসংঘে ইসরাইল রাষ্ট্রের স্বীকৃতি বাতিলের জন্য ও মানবতার শত্রু নেতানেয়াহুর সর্বোচ্চ বিচারের দাবিতে বিশ্ব-দরবারে প্রস্তাব প্রনয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
৫. বাংলাদেশ থেকে যারা ইসরাইলের সঙ্গে ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও রাজনৈতিক স্বার্থে সম্পর্ক স্থাপন বা সহযোগিতার পেছনে জড়িত ছিল কিংবা আছে, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ তদন্ত ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে।
৬. গুজব প্রতিহত ও দেশীয় অর্থনীতি বাঁচাতে
রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসরায়েলি পণ্য ও প্রতিষ্ঠানের
তালিকা প্রস্তুত করে তা দেশে আমদানী ও বাণিজ্য নিষিদ্ধকরণে পলিসি তৈরী করতে হবে।
৭. ইসরাঈলী পণ্য বয়কটের অজুহাতে যারা স্বদেশী ব্যবসায়ী ভাইদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং পণ্য লুটপাট করেছে তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। এবং ভবিষ্যতে এধরণের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ও মব ভায়োলেন্স সৃষ্টির সকল সুযোগ বন্ধ করার নিমিত্তে প্রশাসনিক যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
এছাড়াও আরও কিছু বিষয়ে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সতর্ক থেকে করণীয় – জ্বালানি নিরাপত্তা: দাম বাড়লে দেশে জ্বালানি ভর্তুকি, মূল্যস্ফীতি ও আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে। কূটনৈতিক অবস্থান: বাংলাদেশকে ওআইসি এবং NAM ফোরামে মানবিক অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। মানবিক সহায়তা: বাংলাদেশের NGO ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে গাজা, ইরান ও সিরিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো নৈতিক দায়িত্ব। বৈশ্বিক শান্তি বার্তা:- আন্তর্জাতিক শান্তি প্রণয়নে সংলাপে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করা প্রয়োজন; তবে এটাও ভাবতে হবে – সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’ – এই নীতির চেয়েও জালিম ও মজলুমের পক্ষে অবস্থানও স্পষ্ট করা।
◑ উপসংহার: যুদ্ধ নয়, কূটনীতি হোক পথ। বিশ্ব আরেকটি বড় যুদ্ধের বোঝা বহন করতে পারবে না। এই সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দ্রুত, সমন্বিত এবং কার্যকর পদক্ষেপ অপরিহার্য। মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যত এখন আর তেলের দামে আটকে নেই, বরং এটি নির্ধারণ করছে বিশ্ব কতোটা মানবিক হতে পারে! যদি এখনই পারস্পরিক সহনশীলতা ও কূটনীতির পথ বেছে নেওয়া না হয়, তবে মধ্যপ্রাচ্যের আগুন বৈশ্বিক অস্থিরতাকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে এবং বিশ্বকে এক অনিবার্য বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিতে পারে। এই আগুণের রেখা যেনো আলোতে পরিণত হয়, সেটিই এখন বিশ্বের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ!